সোমবার, ৯ এপ্রিল, ২০১২

নৈসর্গিক অপরুপ সুন্দরী নাফাখুম… বাংলাদেশের নায়াগ্রা

আসসালামু আলাইকুম। আশা করি সবাই ভাল আছেন। আজ আমি আপনাদের কে বাংলাদেশের একটি নৈসর্গিক অপরুপ সুন্দর একটি জনপ্রিয় স্থানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব। এর নাম নাফাখুম…… বাংলাদেশের নায়াগ্রা ! এটি অবশ্য বান্দরবন জেলার পাহাড়ে আবদ্ধ দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত। যাইহোক এবার বিস্তারিত কিছু বলব-

নাফাখুম

 বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি স্থানটি সাঙ্গু নদীর উজানে একটি মারমা বসতী। মারমা ভাষায় 'খুম' মানে হচ্ছে জলপ্রপাত। রেমাক্রি থেকে তিন ঘন্টার হাঁটা পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় আশ্চর্য সুন্দর সেই জলপ্রপাতে, যার নাম 'নাফাখুম'। রেমাক্রি খালের পানি প্রবাহ এই নাফাখুমে এসে বাঁক খেয়ে হঠাৎ করেই নেমে গেছে প্রায় ২৫-৩০ ফুট....প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছে চমৎকার এক জলপ্রপাত! সূর্যের আলোয় যেখানে নিত্য খেলা করে বর্ণিল রংধনু! ভরা বর্ষায় রেমাক্রি খালের জলপ্রবাহ নিতান্ত কম নয়... প্রায় যেন উজানের সাঙ্গু নদীর মতই। পানি প্রবাহের ভলিউমের দিক থেকে সম্ভবতঃ নাফাখুম-ই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। আমার দেশে এত সুন্দর একটা জলপ্রপাত....অথচ আমরা খুব কম জন-ই এই জলপ্রপাতটা সম্মন্ধে জানি!

নাফাখুম (আপস্ট্রীম থেকে তোলা)

  নাফাখুমের পড়ন্ত জলের ধারার নীচে গিয়ে বসার সুযোগ রয়েছে। আমার-আপনার জন্য বিষয়টা বেশ রিস্কি হলেও পাহাড়ীরা জলপ্রপাতের পিছনে বসে অনায়াসে মাছ শিকার করে। এক ধরনের উড়ুক্কু মাছ (স্থানীয় ভাষায় মাছটির নাম নাতিং মাছ) উজান ঠেলে এসে নাফাখুমে বাধাপ্রাপ্ত হয়, লাফ দিয়ে এই প্রপাত-টা আর ক্রস করতে পারেনা....গিয়ে পড়ে জলপ্রপাতের ভিতরে ছোট্ট একটা গুহায়। অনায়াসে সেখান থেকে মাছ সংগ্রহ করে স্থানীয় পাহাড়ীরা ।

রেমাক্রি বাজার (নদী থেকে তোলা)

 রেমাক্রি বাজার থেকে দুইভাবে নাফাখুম-এ যাওয়া যায়। এক ঘন্টা উঁচু-নীচু পাহাড়ী পথ মাড়িয়ে(পাহাড় ডিঙিয়ে) তারপর রেমাক্রি খালের পাড় ধরে বাকিটা হেঁটে চলা। এই পথে গেলে নাফাখুমে পৌঁছাতে আপনার সময় লাগবে চার ঘন্টা। রেমাক্রি খাল ক্রস করতে হবে তিন বার, যার মধ্যে শেষবার আপনাকে সাঁতার পানি পেরুতে হবে। আপনি পাহাড় না ডিঙিয়ে গোটা পথই রেমাক্রি খালের পাশ দিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে নৌকা করে রেমাক্রি খালের মুখে (যেখানে রেমাক্রি খাল সাঙ্গুতে পড়েছে, রেমাক্রিখুম) যেতে হবে আপনাকে...তারপর খালের পাড় দিয়ে হাঁটা পথে নাফাখুম বরাবর। এই পথে আপনাকে চার বার খালটি ক্রস করতে হবে...তবে সময় লাগবে তিন ঘন্টা। আমি আপনাকে দ্বিতীয় পথেই যেতে পরামর্শ দেব...এতে আপনার সময় ও এনার্জী দু'টোই ব্যয় হবে কম। আর শীতের দিনে গেলে খাল ক্রস করার ঝামেলাই নেই.... গোটাটাই আপনি ঝিরিপথ দিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন। তবে শীতকালে নাফাখুম-এর এই পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ হবেনা.... পানি প্রবাহ অনেক কমে যাবে তখন।

রেমাক্রিখুম-টাও খুব সুন্দর! রেমাক্রি বাজারের কাছেই এই 'রেমাক্রি খুম'। রেমাক্রি খাল যেখানে এসে সাঙ্গু নদীতে পড়েছে.... সেটাই রেমাক্রি খুম। 


রেমাক্রিখুম

 পাঁচ-ছয় ফুট উপর থেকে কয়েকটি ধাপে পানি পড়ছে এই জলপ্রপাতে। এ'টি অনেক চওড়া। এই জলপ্রপাতটিও আপনাকে মুগ্ধ করবে নিঃসন্দেহে। তিন্দু থেকে রেমাক্রি যাবার পথেই চোখে পড়বে এই রেমাক্রিখুম।

রেমাক্রিখুম

 আরও কিছু তথ্য শেয়ার করছি এখানে...

নীলগিরি

 বান্দরবান শহর থেকে থানচি উপজেলা (বান্দরবান জেলার সর্বদক্ষিণের উপজেলা) সদরের দূরত্ব ৮২ কিঃমিঃ। রিজার্ভ চাঁদের গাড়ীতে বান্দরবান থেকে থানচি যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টা, ভাড়া নেবে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। পথে চিম্বুক আর নীলগিরিতে নেমে কিছু ছবি তোলার ইচ্ছে থাকলে সময় কিছুটা বেশী লেগে যেতে পারে।

তিন্দু (সাঙ্গুর পাড়ে)

 বর্ষায় ইঞ্জিনবোটে থানচি থেকে তিন্দু যেতে সময় লাগবে আড়াই ঘন্টা। তিন্দু থেকে রেমাক্রি যেতে লাগবে আরও আড়াই ঘন্টা। এই পাঁচ ঘন্টার নৌ-পথে আপনি উজান ঠেলে উপরের দিকে উঠতে থাকবেন আর ভার্টিকেল ডিষ্টেন্স কভার করবেন প্রায় ৫০ মিটার । শীতের সময় ইঞ্জিন বোট চলার মত নদীতে যথেষ্ট গভীরতা থাকেনা...তখন ঠ্যালা নৌকাই একমাত্র বাহন। বর্ষা মৌসুমে তিন দিনের জন্য ইঞ্জিনবোটের ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। আর শীত মৌসুমে ঠ্যালা-নৌকার ভাড়া পড়বে প্রতি দিনের জন্য ১০০০ টাকা।

সাঙ্গু নদীর উজানে হঠাৎ এরকম স্টেপ-ডাউন পাবেন প্রচুর

  থানচি থেকে যত উজানে যাবেন (দক্ষিণে).... নদীর স্লোপ তত বাড়তে থাকবে। গোটা নদীপথেই একটা জেন্টেল স্লোপ-তো আছেই...তার উপরে মাঝে মাঝেই আছে ১ ফুট থেকে ১ মিটার পর্যন্ত খাড়া স্টেপ-আপ। আমি রেমাক্রি ছাড়িয়েও ছোট মওদক পর্যন্ত গেছি। কিন্তু তিন্দু থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত নদীপথ-টুকুই বেশী খরস্রোতা ও একটু ঝুঁকিপূর্ণ।

 ঢালু পাহাড়ী নদী খরস্রোতা হওয়াই স্বভাবিক... বর্ষায় সাঙ্গুও সেইরকম খরস্রোতা। তবে ভয় পাবার কিছু নেই। নৌকার মাঝিরা যথেষ্ট স্কীল বলেই মনে হলো। দু' একটা দূর্ঘটনার গল্প হয়তো শুনবেন.... কিন্তু আমি ভয়ের কিছু দেখিনি, বরং ফেরার সময় রাফটিং-এর একটা মজা উপভোগ করেছি। থাকা-খাওয়ার কিছুটা অসুবিধা মেনে নিলে এমনকি এ্যডভেঞ্চার প্রিয় মেয়েরাও অনায়াসে রেমাক্রি পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারবেন।

চমৎকার সুস্বাদু চাঁপা কলা

 থানচি থেকে নৌকায় উঠার সময় মাত্র ১০০ টাকায় এইরকম এক কাঁদি চাঁপা কলা নৌকায় তুলে নিলে.... পথে বেশ কাজে লাগবে।

* হাতি পোকার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এন্টি মসক্যুইটো ক্রীম নিতে ভুলবেন না।

 *বিডিআর ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা না করতে পারলেও কোন অসুবিধা নেই। নিশ্চিন্ত মনে বছরের যে কোন সময় ৪ থেকে ৬ জনের গ্রুপ নিয়ে চলে যান তিন্দু, রেমাক্রি। মারমাদের বাঁশ-কাঠের বাড়ীতে অনায়াসে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে আপনাদের। মারমাদের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই খুব অল্প টাকায় এমন থাকা-খাওয়ার সুবিধে রয়েছে। তিনবেলা খাওয়ার খরচ পরবে জনপ্রতি ২০০ টাকা, আর থাকা ফ্রি। তবে যে বাড়ীতে ফ্রি থাকবেন... খেতে হবে তাঁর দাওয়ায় বসেই।

 *থানচি পর্যন্ত আপনার টেলিটক মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাবেন। তিন্দু গিয়ে আপনার মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকলেও আপনি একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবেন না। মারমাদের দোকান থেকে বাঁশের উপর এ্যন্টেনা লাগানো সেট থেকে চাইলে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন। কিন্তু রেমাক্রি পৌঁছালে আপনি একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।

থানচি বা নাফাখুমের পথে সম্ভাব্য খরচ এবং ব্যবস্থা এমন.....

ঢাকা – বান্দরবান

বাস; ৩০০-৪০০ টাকা; ৭-৯ ঘন্টা

বান্দরবান – থানচি
বাস; ১৬৫ টাকা; ৫-৬ ঘন্টা
জীপ; ৪০০০-৫০০০ টাকা; ৪-৫ ঘন্টা
সাঙ্গু নদী পারাপার; জনপ্রতি ৫ টাকা
ঘর ভাড়া
প্রতি রুম; ২০০-৪০০ টাকা
প্রতি বেডিং; ৫০-৭০ টাকা প্রতি রাত
খাবার
গড়পরতায় নাস্তা ৫০-৮০ টাকা; দুপুর এবং রাতের খাবার ৭০-১২০ টাকা। হোটেলে আগেই কথা বলে রাখা ভালো। এতে প্রাপ্তির উপর নির্ভর করে ইচ্ছে মতোন মাছ, মাংস, সবজি বা ডিমের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা যায়।
বোট
গন্তব্যের দূরত্বের উপর নির্ভর করে ৩০০০-৭০০০ টাকা ভাড়া; এক্ষেত্রে ভ্রমণ পরিকল্পনায় যদি তিন্দু বা রেমাক্রিতে রাত কাটাতে হয় তবে মাঝি/বোট আপনাদের সাথে থাকবে। সেটা বিবেচনায় রেখেই বোট ভাড়া করতে হয়। শীট মৌসুমে ঠ্যালা নৌকার জন্যে প্রতি দিনের জন্যে ভাড়া ১০০০ টাকা।
তিন্দুতে থাকার ব্যবস্থা
এখানে মারমাদের বাস। এই আদিবাসীদের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে যেই বাড়িতে আপনি থাকবেন, সেখানেই আপনাকে খাবার খেতে হবে। খাওয়ার খরচ তিন বেলায় ২০০ টাকা। এক্ষেত্রে থাকার জন্যে কোন খরচ দিতে হবে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে শুধুমাত্র টেলিটকের। মোবাইল চার্জ দেবার ব্যবস্থা আছে।
রেমাক্রি
রেমাক্রি চেয়ারম্যানের নাম আফ্রো মং; তাঁর একটা রেস্ট হাউজ আছে এখানে, একটা পাহাড়ের মাথায়। এক রুমের ভাড়া ৫০০ টাকা, ১০-১২ জন থাকা যায়। রেমাক্রি বাজারে খাবার খরচ জনপ্রতি ৬০-৭০ টাকা। আগে থেকে কথা বলে দাম ঠিক করে নেয়া ভালো। গাইডের ভাড়া ৩০০-৫০০ টাকা।
শীতের সময় থানচি থেকে বোট ছাড়াও হেঁটে রেমাক্রি, নাফাখুম যাওয়া যায়। তখন থানচি থেকে তিন্দু পৌঁছতে ৬ ঘন্টা এবং তিন্দু থেকে রেমাক্রি পৌঁছতে আরো ৫ ঘন্টা সময় লাগে। “বড় পাথর” স্থানটি ভালো করে ঘুরে দেখা যায় কারণ তখন স্রোত খুব একটা থাকে না। রেমাক্রি থেকে নাফাখুম যেতে দুটো রুট আছে। একটা রেমাক্রি বাজারের আগে রেমাক্রিখুমের মুখ থেকে আর অন্যটা রেমাক্রি বাজার থেকে দুটো পাহাড় ডিঙিয়ে তারপর রেমাক্রি খালের পাড় ধরে। প্রথম ক্ষেত্রে রেমাক্রি খাল পেরোতে হবে চার বার দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তিন বার। সময়ের পার্থক্যে ৩০-৪০ মিনিট বেশি লাগবে প্রথম রুটে।

 ........একবার সুযোগ করে ঘুরে আসুন তিন্দু, বড়পাথর, রেমাক্রি, নাফাখুম.... উপভোগ করে আসুন ভিন্ন এক থ্রিলিং প্রকৃতি। স্যাটিসফেকশন গ্যারান্টেড!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন